ঢাকা ০৪:৪৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম :
দুই লাখ টাকার মাইলফলক ছাড়ালো স্বর্ণের ভরি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ পেছানোর যুক্তি নেই : আনিসুজ্জামান চৌধুরী জাকসুর ভিপি স্বতন্ত্রপ্রার্থী জিতু, জিএস শিবিরের মাজহারুল আইন শক্তিশালী না হলে শতভাগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না ইসলামী ব্যাংকের নতুন এমডি ওমর ফারুক খাঁন ৫০ কোটির ব্যাংক গ্যারান্টিতে শত শত কোটি টাকার টিকিট বেচতো ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ ‘রিফান্ড’ আতঙ্কে টিকিটের টাকা গচ্চার শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা গ্রাহক ও এজেন্সির কয়েকশ’ কোটি টাকা নিয়ে ‘লাপাত্তা’ ফ্লাইট এক্সপার্ট পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসা ‘সন্তোষজনক’: আমীর খসরু অশুল্ক চুক্তির ব্যাপারে কূটনৈতিক ব্যাখ্যা জরুরি: ড. গোলাম মোয়াজ্জেম

বাংলাদেশের অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়েছে, দ্রুত মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে

ড. মাহফুজ কবির

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ৬ মাস পর এসে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল দুর্নীতি আর ব্যাংক লুটপাটের  কারণে সৃষ্ট ক্ষত থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। দেশী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্রে তৈরি হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট চক্র ভেঙে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্যাংক থেকে লুট করা ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসা শুরু হবে।

কিন্তু যেন হচ্ছে উল্টোটা। দেশের অর্থনীতি স্বস্তিতে নেই। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অনেকটাই স্থবির। একদিকে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে ব্যবসায়-বাণিজ্যে ধীরগতি। এ কারণে বেকারত্ব বাড়ছে। বছরখানেক ধরে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের বড় প্রত্যাশা ছিল বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমবে। বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি হবে। জিনিসপত্রের দাম নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তসহ সীমিত আয়ের মানুষের হাতের নাগালে আসবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। মূল্যস্ফীতির চাপ একেবারেই কমছে না। মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ ও সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের ধীরগতি সরকারের সাফল্যকে ক্রমশ ম্লান করে দিচ্ছে।

অর্থনীতিতে এত দীর্ঘ সময় ধরে কেন অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি উচ্চ বিরাজ করছে? কেন মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে বশে আনা যাচ্ছে না? আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদের হারকে বাড়াতে বাড়াতে ডাবল ডিজিটে নিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তি ছিল, নীতি সুদের হার বাড়ালে ঋণের সুদের হারও বাড়বে এবং বাজারে অর্থের যোগান হ্রাস পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফের পরামর্শ মেনে সংকোচনমূলক মুদ্রা নীতি বাস্তবায়ন করছে। এর কারণে একদিকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ সংকুচিত হচ্ছে, অন্য দিকে উচ্চ ঋণের সুদের হারের কারণে বেসরকারি খাতও ব্যবসায়ের জন্য ঋণ নিতে উৎসাহিত হচ্ছে না। বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র সাত শতাংশের মতো। এতো নিচু ঋণের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের গত দুই দশকেও দেখা যায়নি। এমন আত্মঘাতী মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারি বিনিয়োগে বেহাল দশা। উচ্চ সুদের হারের কারণে উৎপাদন ও ব্যবসায়ের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে পন্য ও সেবার মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে।

দেশে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিক্ষোভ হচ্ছে। কোথাও বন্ধ হচ্ছে কারখানা। মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে। বিদেশী বিনিয়োগেও কোন সুখবর নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ জুন ২০২৪ তথ্য অনুযায়ী বিগত অর্থ বছরে (২০২৩-২৪) নেট বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রভাব ছিল দেড় বিলিয়ন ডলারের নিচে এর মধ্যে ইকুইটি ক্যাপিটাল, যা বিদেশি বিনিয়োগের মূল উৎস, ছিল অতি সামান্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন দেশে ডলার সংকটের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের মুনাফা ও পুঁজি  ফেরত নিতে পারছেন না বলে সেগুলো পুনর্বিনিয়োগ করছেন। এ কারণে তবুও দেড় বিলিয়ন ডলারের মত সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে। পুঁজি ও মুনাফা ফেরত নিতে পারলে হয়তো এই দেড় বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগও দেখা যেত না।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডা কি করছে? মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা কি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে যাচ্ছেন? বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভালো ভাবমূর্তি তুলে ধরছেন? দেশে যে এতগুলো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে যেখানে ভারী শিল্প, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, সেমিকন্ডাক্টর এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের যে দারুণ সুযোগ রয়েছে তাকি বিডা ও অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরে বিদেশী বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ সচেষ্ট রয়েছে? এসব এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন।

এসব হতাশার মাঝে আশার আলো ছড়াচ্ছে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স। আগস্ট পরবর্তী সময়ে রেমিটেন্সের ঊর্ধ্বগতি, ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড রেমিটেন্স প্রবাহ এবং গত চার মাস ধরে প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের পতনকে ঠেকাতে  অনেকটা সহায়তা করেছে। নতুন বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য বিরোধের শঙ্কা সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন করে শুরু হওয়ায় বাংলাদেশের পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির সম্ভাবনা আরো বেড়ে গেছে। চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে নতুন বিনিয়োগ আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সে সুযোগ বিডা ঠিক মত কাজে লাগাতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না।

বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রেও হতাশা রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ব্যাংক , আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবি বিপুল পরিমাণে উন্নয়ন সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু সে আশ্বাস অনেকটাই ফিকে হয়ে পড়েছে। আইএমএফ-এর ঋণের পরবর্তী কিস্তি ফেব্রুয়ারির মধ্যে অনুমোদনের কথা থাকলেও এটি পেছাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক চলমান প্রকল্পের পাশাপাশি অতিরিক্ত কয়েক বিলিয়ন ডলার সহায়তার আশ্বাস দিল দিলেও তারা তা পূরণ করছে না। অন্যদিকে এডিবি নতুন সহায়তা নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়াচ্ছে না, যদিও তারা সকলেই জানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমে যেমন অর্থায়ন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বাজেট সহায়তা। বৈদেশিক সাহায্য বাড়লে ডলারের ঘাটতি ও ক্রমবর্ধন ডলারের চাহিদা অনেকটা পূরণ করা যেত, আর বৈদেশিক বিনিময়ের হারের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা হলেও রোধ করা যেত। এই মুহূর্তে বাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২৮ টাকার মতো। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে এবং সরবরাহ সংকটের কারণে আমদানি ঋণপত্র খুলতে এবং দায় পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ঋণমান কমে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের বৈদেশিক দায় পরিষদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

রাজস্ব আদায় নিয়ে সরকার বেশ অস্বস্তিতে আছে। ২০২৩-এর জুলাই ডিসেম্বর তুলনায় ২০২৪-এর একই সময়ে রাজস্ব আদায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর-এর রাজস্ব আদায় প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। কিন্তু বিগত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে সরকারের খরচ বেড়ে গেছে। ব্যাংক ব্যবস্থা আর সংকোচন মূলক মুদ্রানীতির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের সুযোগ কমে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করলে ওই অর্থবছরেই ফেরত দিতে হয় বলে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ঋণ নিতে অনেকটা অনাগ্রহী। রাজস্ব আয় কম হওয়ার দুটো কারণ রয়েছে। একটি হলো ব্যবসায়-বাণিজ্য মন্দা। আর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ব্যবসায়ীদের একটি অংশ সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে না। অবশ্য আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমদানি অনেক কম হওয়ার কারণেও আমদানির শুল্ক ও আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আহরণ কমে গেছে। এ কারণে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের কমে গেছে কম হয়েছে।

তবে সরকারকে সবচাইতে বেশি অস্থির অস্বস্তিতে ফেলেছে অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে জানুয়ারিতে একশটির বেশি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির নেতিবাচক অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া। এনবিআর কর্তৃক ওষুধসহ খুব সামান্য কয়েকটি পণ্যের ও সেবার উপর থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কিছুটা হ্রাস ও প্রত্যাহার করা হলেও প্রায় সব পণ্য ও সেবার উপর বর্ধিত কর ও শুল্ক বহাল রয়েছে। এতে এসব পণ্য ও সেবার দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি এসবের ব্যবসায় ও বিনিয়োগও কমে গেছে। এর ফলে এনবিআর অত্যন্ত অজনপ্রিয় এসব কর-শুল্ক বৃদ্ধি থেকে প্রায় সাড়ে বারো হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্বের যে প্রত্যাশা করছিল তা পূরণ নাও হতে পারে।

ব্যাংক খাতের দুর্দশা যেন কাটছেই না। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন মাত্র বারোটি ব্যাংক ভালো করছে আর বাকিগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তার মানে, বাংলাদেশ ব্যাংক গত ছয় মাসে তেমন কোন উদ্যোগ নিতে পারেনি যাতে দুর্বল ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমেছে। শোনা যাচ্ছে, বিগত সরকারের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এমন লুটপাট হয়েছে যে, সেগুলো আগামী দশ বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ। তারল্য সংকট রয়েছে ১৮টি ব্যাংকের। তীব্র তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছেপে সহায়তা দেওয়ার পরও তাদের সংকট কাটছে না। আর সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর জন্য যে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে সেগুলো থেকে আন্তঃব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার ফলে ভালো ব্যাংকগুলো খারাপ ব্যাংকগুলোতে ঋণ দিচ্ছে বলে তারা শিল্পায়ন ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে ব্যাংক গুলো স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াতে পারছে না। খেলাপি ঋণ ফেরত আনার কোন কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করছে না বলে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতিও হচ্ছে না। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে কিছু কথাবার্তা হলেও তা কাজে পরিণত হচ্ছে না। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে সংস্কার সুদূর পরাহতই থেকে যাচ্ছে।

পুঁজিবাজারের অবস্থা আরো ভয়াবহ। প্রতিদিন বিনিয়োগকারীরা তাদের সর্বস্ব হারাচ্ছেন। আগস্টে সরকার পতনের প্রথম কয়েকদিন পুঁজিবাজারে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ এসেছিল। এরপর বাজার থেকে টাকাগুলো বেরিয়ে গেছে। এখন পুঁজিবাজারের ওপরে তীব্র অনাস্থ্যার কারণে কেউ সেখানে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে যাচ্ছেন না। যাদের বিনিয়োগ আছে তারা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাচ্ছেন। অথচ শিল্প ও ব্যবসায়ের দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির মূল যোগানদাতা হওয়ার কথা ছিল পুঁজিবাজারের। আর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ জায়গাতে সংস্কার করে যারা কারসাজি করছেন তাদের শাস্তি হওয়ার উচিত ছিল। কিন্তু চিহ্নিত লুটেরা ও বড় আকারের কারসাজির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদ্যোগ নেওয়া দূরে থাক, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা এতটুকু ফেরাতে পারিনি ।

অর্থনীতির এ এমন দুর্দশা ও ব্যবস্থাপনা ও চলতে থাকলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগ, সংস্কার কর্মকাণ্ড ও সাফল্য ম্লান হতে থাকবে। তাই সরকারকে খুব দ্রুত নয়টি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এক, আত্মঘাতী সংকোচন মূলক মুদ্রানীতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি নমনীয় মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হবে যাতে ব্যবসায়ীরা সহজে ও কম খরচে ঋণ পায়। এজন্য ঋণের সুদের হার কমাতে হবে। এতে ব্যবসায়ের খরচ কমবে এবং তা মূল্যস্ফীতিকেও কমাতে সহায়তা করবে। দুই, রাজস্ব আয় বাড়ানোর সবচাইতে ভালো উপায় কর ব্যবস্থার অটোমেশন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি। সরকারকে সে পথে হাঁটতে হবে। তিন, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজার ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য রোধ করতে হবে। প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরো বেশি কার্যকর ও উদ্যোগী হতে হবে যাতে বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ বজায় থাকে এবং যোগানের ক্ষেত্রে অকারণে সংকট তৈরি না। রমজানে ব্যবহারের জন্য খেজুর, ছোলা ও চিনিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্যের উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে বা কমিয়ে এবং এলসি খোলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে সরকার সেসব পণ্যের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর ফলে এসব পণ্যের আমদানিও বেড়েছে। সুতরাং রমজানের সময় বাজারে যেন কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয় সরকারকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

চার, খেলাপি ঋণ আদায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সাথে পারস্পরিক আইনগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। পাঁচ, বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবি’র পাশাপাশি অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। ছয়, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নতুন বাজার ধরতে হবে। সাত, রেমিটেন্স প্রেরণের ক্ষেত্রে হুন্ডি চক্র এখনো বেশ সক্রিয়। তাদেরকে আইনের আওতায় দমনের পাশাপাশি বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যসহ যেসব দেশে প্রবাসী শ্রমিকেরা দূর দূরান্তে কাজ করেন তাদের কাছে গিয়ে রেমিটেন্সের অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। আট, পুঁজিবাজারে মানুষের আস্থা ফেরানোর জন্য বিএসইসি’র বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ বাতিল করে একটি দক্ষ ও শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে। পাশাপাশি শেয়ার বাজারে লুটেরা ও কারসাজিতে জড়িতদের তালিকা তৈরি করে জনসমক্ষে প্রকাশ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে পারলে পুঁজিবাজার খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। নয়, ব্যবসায়ের অবকাঠামো ও পরিবেশ উন্নত করতে হবে এবং খরচ কমাতে হবে। নতুন বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে অনুমোদন ও সনদ পাবার ক্ষেত্রে সিঙ্গেল উইন্ডো স্থাপন করতে হবে। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে।

সংস্কার কমিশন গুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক ঐক্য গঠনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে মানুষের আস্থার শক্ত ভিত তৈরি করা হতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখনকার সবচাইতে বড় অগ্রাধিকার।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ১০:৩৯:২১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫
২৯৪ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়েছে, দ্রুত মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে

আপডেট সময় ১০:৩৯:২১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ৬ মাস পর এসে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল দুর্নীতি আর ব্যাংক লুটপাটের  কারণে সৃষ্ট ক্ষত থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। দেশী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্রে তৈরি হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট চক্র ভেঙে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্যাংক থেকে লুট করা ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসা শুরু হবে।

কিন্তু যেন হচ্ছে উল্টোটা। দেশের অর্থনীতি স্বস্তিতে নেই। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অনেকটাই স্থবির। একদিকে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে ব্যবসায়-বাণিজ্যে ধীরগতি। এ কারণে বেকারত্ব বাড়ছে। বছরখানেক ধরে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের বড় প্রত্যাশা ছিল বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমবে। বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি হবে। জিনিসপত্রের দাম নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তসহ সীমিত আয়ের মানুষের হাতের নাগালে আসবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। মূল্যস্ফীতির চাপ একেবারেই কমছে না। মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ ও সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের ধীরগতি সরকারের সাফল্যকে ক্রমশ ম্লান করে দিচ্ছে।

অর্থনীতিতে এত দীর্ঘ সময় ধরে কেন অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি উচ্চ বিরাজ করছে? কেন মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে বশে আনা যাচ্ছে না? আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ-এর পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদের হারকে বাড়াতে বাড়াতে ডাবল ডিজিটে নিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তি ছিল, নীতি সুদের হার বাড়ালে ঋণের সুদের হারও বাড়বে এবং বাজারে অর্থের যোগান হ্রাস পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে আইএমএফের পরামর্শ মেনে সংকোচনমূলক মুদ্রা নীতি বাস্তবায়ন করছে। এর কারণে একদিকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ সংকুচিত হচ্ছে, অন্য দিকে উচ্চ ঋণের সুদের হারের কারণে বেসরকারি খাতও ব্যবসায়ের জন্য ঋণ নিতে উৎসাহিত হচ্ছে না। বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র সাত শতাংশের মতো। এতো নিচু ঋণের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের গত দুই দশকেও দেখা যায়নি। এমন আত্মঘাতী মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারি বিনিয়োগে বেহাল দশা। উচ্চ সুদের হারের কারণে উৎপাদন ও ব্যবসায়ের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে পন্য ও সেবার মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে।

দেশে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিক্ষোভ হচ্ছে। কোথাও বন্ধ হচ্ছে কারখানা। মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে। বিদেশী বিনিয়োগেও কোন সুখবর নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ জুন ২০২৪ তথ্য অনুযায়ী বিগত অর্থ বছরে (২০২৩-২৪) নেট বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রভাব ছিল দেড় বিলিয়ন ডলারের নিচে এর মধ্যে ইকুইটি ক্যাপিটাল, যা বিদেশি বিনিয়োগের মূল উৎস, ছিল অতি সামান্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন দেশে ডলার সংকটের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের মুনাফা ও পুঁজি  ফেরত নিতে পারছেন না বলে সেগুলো পুনর্বিনিয়োগ করছেন। এ কারণে তবুও দেড় বিলিয়ন ডলারের মত সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে। পুঁজি ও মুনাফা ফেরত নিতে পারলে হয়তো এই দেড় বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগও দেখা যেত না।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডা কি করছে? মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা কি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে যাচ্ছেন? বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভালো ভাবমূর্তি তুলে ধরছেন? দেশে যে এতগুলো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে যেখানে ভারী শিল্প, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, সেমিকন্ডাক্টর এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের যে দারুণ সুযোগ রয়েছে তাকি বিডা ও অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরে বিদেশী বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ সচেষ্ট রয়েছে? এসব এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন।

এসব হতাশার মাঝে আশার আলো ছড়াচ্ছে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স। আগস্ট পরবর্তী সময়ে রেমিটেন্সের ঊর্ধ্বগতি, ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড রেমিটেন্স প্রবাহ এবং গত চার মাস ধরে প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের পতনকে ঠেকাতে  অনেকটা সহায়তা করেছে। নতুন বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য বিরোধের শঙ্কা সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন করে শুরু হওয়ায় বাংলাদেশের পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির সম্ভাবনা আরো বেড়ে গেছে। চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে নতুন বিনিয়োগ আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সে সুযোগ বিডা ঠিক মত কাজে লাগাতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না।

বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রেও হতাশা রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ব্যাংক , আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবি বিপুল পরিমাণে উন্নয়ন সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু সে আশ্বাস অনেকটাই ফিকে হয়ে পড়েছে। আইএমএফ-এর ঋণের পরবর্তী কিস্তি ফেব্রুয়ারির মধ্যে অনুমোদনের কথা থাকলেও এটি পেছাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক চলমান প্রকল্পের পাশাপাশি অতিরিক্ত কয়েক বিলিয়ন ডলার সহায়তার আশ্বাস দিল দিলেও তারা তা পূরণ করছে না। অন্যদিকে এডিবি নতুন সহায়তা নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়াচ্ছে না, যদিও তারা সকলেই জানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমে যেমন অর্থায়ন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বাজেট সহায়তা। বৈদেশিক সাহায্য বাড়লে ডলারের ঘাটতি ও ক্রমবর্ধন ডলারের চাহিদা অনেকটা পূরণ করা যেত, আর বৈদেশিক বিনিময়ের হারের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা হলেও রোধ করা যেত। এই মুহূর্তে বাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২৮ টাকার মতো। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে এবং সরবরাহ সংকটের কারণে আমদানি ঋণপত্র খুলতে এবং দায় পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ঋণমান কমে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের বৈদেশিক দায় পরিষদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

রাজস্ব আদায় নিয়ে সরকার বেশ অস্বস্তিতে আছে। ২০২৩-এর জুলাই ডিসেম্বর তুলনায় ২০২৪-এর একই সময়ে রাজস্ব আদায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর-এর রাজস্ব আদায় প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। কিন্তু বিগত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে সরকারের খরচ বেড়ে গেছে। ব্যাংক ব্যবস্থা আর সংকোচন মূলক মুদ্রানীতির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের সুযোগ কমে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করলে ওই অর্থবছরেই ফেরত দিতে হয় বলে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ঋণ নিতে অনেকটা অনাগ্রহী। রাজস্ব আয় কম হওয়ার দুটো কারণ রয়েছে। একটি হলো ব্যবসায়-বাণিজ্য মন্দা। আর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ব্যবসায়ীদের একটি অংশ সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে না। অবশ্য আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমদানি অনেক কম হওয়ার কারণেও আমদানির শুল্ক ও আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আহরণ কমে গেছে। এ কারণে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের কমে গেছে কম হয়েছে।

তবে সরকারকে সবচাইতে বেশি অস্থির অস্বস্তিতে ফেলেছে অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে জানুয়ারিতে একশটির বেশি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির নেতিবাচক অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া। এনবিআর কর্তৃক ওষুধসহ খুব সামান্য কয়েকটি পণ্যের ও সেবার উপর থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কিছুটা হ্রাস ও প্রত্যাহার করা হলেও প্রায় সব পণ্য ও সেবার উপর বর্ধিত কর ও শুল্ক বহাল রয়েছে। এতে এসব পণ্য ও সেবার দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি এসবের ব্যবসায় ও বিনিয়োগও কমে গেছে। এর ফলে এনবিআর অত্যন্ত অজনপ্রিয় এসব কর-শুল্ক বৃদ্ধি থেকে প্রায় সাড়ে বারো হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্বের যে প্রত্যাশা করছিল তা পূরণ নাও হতে পারে।

ব্যাংক খাতের দুর্দশা যেন কাটছেই না। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন মাত্র বারোটি ব্যাংক ভালো করছে আর বাকিগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তার মানে, বাংলাদেশ ব্যাংক গত ছয় মাসে তেমন কোন উদ্যোগ নিতে পারেনি যাতে দুর্বল ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমেছে। শোনা যাচ্ছে, বিগত সরকারের আমলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এমন লুটপাট হয়েছে যে, সেগুলো আগামী দশ বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ। তারল্য সংকট রয়েছে ১৮টি ব্যাংকের। তীব্র তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছেপে সহায়তা দেওয়ার পরও তাদের সংকট কাটছে না। আর সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর জন্য যে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে সেগুলো থেকে আন্তঃব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার ফলে ভালো ব্যাংকগুলো খারাপ ব্যাংকগুলোতে ঋণ দিচ্ছে বলে তারা শিল্পায়ন ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে ব্যাংক গুলো স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াতে পারছে না। খেলাপি ঋণ ফেরত আনার কোন কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করছে না বলে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতিও হচ্ছে না। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে কিছু কথাবার্তা হলেও তা কাজে পরিণত হচ্ছে না। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে সংস্কার সুদূর পরাহতই থেকে যাচ্ছে।

পুঁজিবাজারের অবস্থা আরো ভয়াবহ। প্রতিদিন বিনিয়োগকারীরা তাদের সর্বস্ব হারাচ্ছেন। আগস্টে সরকার পতনের প্রথম কয়েকদিন পুঁজিবাজারে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ এসেছিল। এরপর বাজার থেকে টাকাগুলো বেরিয়ে গেছে। এখন পুঁজিবাজারের ওপরে তীব্র অনাস্থ্যার কারণে কেউ সেখানে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে যাচ্ছেন না। যাদের বিনিয়োগ আছে তারা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাচ্ছেন। অথচ শিল্প ও ব্যবসায়ের দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির মূল যোগানদাতা হওয়ার কথা ছিল পুঁজিবাজারের। আর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ জায়গাতে সংস্কার করে যারা কারসাজি করছেন তাদের শাস্তি হওয়ার উচিত ছিল। কিন্তু চিহ্নিত লুটেরা ও বড় আকারের কারসাজির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদ্যোগ নেওয়া দূরে থাক, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা এতটুকু ফেরাতে পারিনি ।

অর্থনীতির এ এমন দুর্দশা ও ব্যবস্থাপনা ও চলতে থাকলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগ, সংস্কার কর্মকাণ্ড ও সাফল্য ম্লান হতে থাকবে। তাই সরকারকে খুব দ্রুত নয়টি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এক, আত্মঘাতী সংকোচন মূলক মুদ্রানীতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি নমনীয় মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হবে যাতে ব্যবসায়ীরা সহজে ও কম খরচে ঋণ পায়। এজন্য ঋণের সুদের হার কমাতে হবে। এতে ব্যবসায়ের খরচ কমবে এবং তা মূল্যস্ফীতিকেও কমাতে সহায়তা করবে। দুই, রাজস্ব আয় বাড়ানোর সবচাইতে ভালো উপায় কর ব্যবস্থার অটোমেশন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি। সরকারকে সে পথে হাঁটতে হবে। তিন, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজার ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য রোধ করতে হবে। প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরো বেশি কার্যকর ও উদ্যোগী হতে হবে যাতে বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ বজায় থাকে এবং যোগানের ক্ষেত্রে অকারণে সংকট তৈরি না। রমজানে ব্যবহারের জন্য খেজুর, ছোলা ও চিনিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্যের উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে বা কমিয়ে এবং এলসি খোলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে সরকার সেসব পণ্যের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর ফলে এসব পণ্যের আমদানিও বেড়েছে। সুতরাং রমজানের সময় বাজারে যেন কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয় সরকারকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

চার, খেলাপি ঋণ আদায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সাথে পারস্পরিক আইনগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। পাঁচ, বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবি’র পাশাপাশি অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। ছয়, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নতুন বাজার ধরতে হবে। সাত, রেমিটেন্স প্রেরণের ক্ষেত্রে হুন্ডি চক্র এখনো বেশ সক্রিয়। তাদেরকে আইনের আওতায় দমনের পাশাপাশি বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যসহ যেসব দেশে প্রবাসী শ্রমিকেরা দূর দূরান্তে কাজ করেন তাদের কাছে গিয়ে রেমিটেন্সের অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। আট, পুঁজিবাজারে মানুষের আস্থা ফেরানোর জন্য বিএসইসি’র বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ বাতিল করে একটি দক্ষ ও শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে। পাশাপাশি শেয়ার বাজারে লুটেরা ও কারসাজিতে জড়িতদের তালিকা তৈরি করে জনসমক্ষে প্রকাশ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে পারলে পুঁজিবাজার খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। নয়, ব্যবসায়ের অবকাঠামো ও পরিবেশ উন্নত করতে হবে এবং খরচ কমাতে হবে। নতুন বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে অনুমোদন ও সনদ পাবার ক্ষেত্রে সিঙ্গেল উইন্ডো স্থাপন করতে হবে। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে।

সংস্কার কমিশন গুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক ঐক্য গঠনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে মানুষের আস্থার শক্ত ভিত তৈরি করা হতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখনকার সবচাইতে বড় অগ্রাধিকার।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ