ব্যাংক খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও কিছু প্রশ্ন
৭ জুন ২০২৪, শুক্রবার। রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তন। চলছে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন। মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের পদচারণায় সরগরম। মঞ্চের ডানপাশে বসে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। কিছুটা চিন্তিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করা নিয়ে তার বিরুদ্ধে চলছে নানা সমালোচনা। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর বক্তব্যের পরই মাইক হাতে নিয়ে অর্থনীতির সংবাদ সংগ্রহ করা সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম-ইআরএফ সভাপতি চলমান সংবাদ সম্মেলনে গভর্নরকে বয়কটের ঘোষণা দিলেন।
দেশের প্রায় সবগুলো টিভি চ্যানেল (বিটিভিসহ) লাইভ করছিল। লাখ লাখ মানুষ দেখলেন সেই ঘটনা। বিদেশে বসেও অনেকে দেখেছেন। দেশের ইতিহাসে এমনভাবে কোন গভর্নরকে কখনো বয়কটের মুখে পড়তে হয়নি। বিষয়টা তার জন্য লজ্জাজনকও ছিল। অবশ্য সেটা তিনি গায়ে মেখেছিলেন কিনা বলা মুশকিল। ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হলে বয়কটের ঘোষণার পরই হয়তো হল ত্যাগ করে চলে যেতেন। সংবাদ সম্মেলন শেষ না হওয়া অবধি বিষন্ন মুখে ঠাঁয় চেয়ারে বসেছিলেন।
এই ঘটনার দু’মাসেরও কম সময়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর পিছনে যেমন বৈষম্য, গুম, খুন, বিচারবর্হিভ‚ত হত্যাকাÐ থেকে ছিল জনসাধারণের পুঞ্জিভ‚ত ক্ষোভ, একইসঙ্গে আর্থিকখাতের লুটপাটের চিত্রও জনগণের মানসপটে ছিল। সেই দেখাটা বন্ধ করতেই বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন ডি-গ্রেড পাওয়া গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
দুর্নীতিবাজ আমলা, লুটেরা ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবদ এবং পাচারকারীদের সঙ্গে নিয়ে আর্থিকখাতকে পঙ্গু করার নীলনকশা বাস্তবায়ন চলছিল। তাইতো সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাকেও গা ঢাকা দিতে হয়েছে কিংবা পালিয়ে গেছেন। পৃথিবীর কোনো দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের এমন পরিস্থিতির উদাহরণ আছে কিনা, জানা নেই। এমনকি দেউলিয়া ঘোষণা করা শ্রীলঙ্কাতেও এমন কিছু হয়নি। আব্দুর রউফ তালুকদারের নিজের পরিণতিই প্রমাণ করে আর্থিকখাতকে তিনি কতটা দুর্দশায় ফেলেছিলেন।
তিনি যে একা সেই কাজ করেছেন তা নয়। তার পূর্বের দুই গভর্নর ফজলে কবির ও আতিউর রহমান এর ভিত রচনা করে দিয়েছিলেন। আর রউফ তালুকদার তার সহযোগী হিসেবে পেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের। তাদের একজন, সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুরকে চৌধুরীকে, গত ১৪ জানুয়ারি যাকে গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিনি এখন জেলহাজতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, দুদককে সম্পদের বিবরণী নোটিশের জবাব দেননি।
এদিকে, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জানুয়ারি মাসের শুরুতে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। তিনিও এখন জেল হাজতে আছেন। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত ধ্বংসের কারিগর হিসেবে অভিযুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান করছে। হয়তো তাকেও আটক করা হবে, যদি না দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে থাকেন।
এগুলো মাত্র কয়েকটি নাম বা উদাহরণ। আর্থিকখাতের অভিভাবক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এমন আরো অনেক কর্মকর্তা হয়তো আছেন, যাদের ব্যাপারে আমরা জানি না। একটি বিশাল চক্র গড়ে তুলে এরা রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের ব্যাংক লুটপাটে সাহায্য করেছে। যার ভাগ তারাও পেয়েছেন। লুটপাটের পরিমাণ এত ছিল যে, তা দিয়ে অন্তত ১৪টি মেট্রোরেল কিংবা ২৪টি পদ্মাসেতু তৈরি করা সম্ভব ছিল। অর্থনীতির শ্বেতপত্র তাই বলছে।
অনিয়মের ফলাফল হিসেবে, খেলাপি ঋণ এখন ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই ঋণ যাতে না বাড়ে সেজন্য খেলাপির সংজ্ঞাই পরিবর্তন করা হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটের সুযোগ তৈরি করে দিতে, এমন উদাহরণ বিশে^ আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিশেষ একটি শিল্পগোষ্ঠীর কব্জায় থাকা ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারে মনযোগী হয়। ভেঙ্গে দেয় ওই সব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ নির্ধারণে আন্তর্জাতিক চর্চা আবারো ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই চর্চা ঠিকভাবে শুরু না হলে খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যে বিপুল লুটপাট হয়েছে আর্থিকখাতে তার বিপরীতে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে? একটি শিল্প গ্রæপের হাতে থাকা ৮টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়াই কী সমাধান? এসব ব্যাংকে তো তাদের নামে শেয়ার ঠিকই আছে। অথচ এসব শেয়ার তাদেরকে দিয়ে কিনিয়েছিল রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। ইসলামী ব্যাংক তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাহলে এই প্রশ্ন এসেই যায়, ব্যাংকগুলোকে প্রকৃত মালিকদের কাছে কী ফিরিয়ে দেয়া হবে? যদি হয় তাহলে তার প্রক্রিয়া কী হবে? আশা করা যায় সামনে এগুলো পরিষ্কার হবে।
ব্যাংকগুলোর লুটেরা পরিচালকদের অপসারণ করেই কী দায়িত্ব শেষ করতে চাইছেন নতুন গভর্নর? তাদের বিরুদ্ধে কী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে না? আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে বাংলাদেশের চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের ৫টি একাউন্টের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। এর পেছনে দায় খুঁজে পাওয়া যায় ওই ব্যাংকের ম্যানেজার মায়া দেউগুতোর (নারী)। তাকে ৭ বছরের কারাদÐ ও ১০৯ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছে আদালত।
আর আমরা কী করছি? এখন পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে কোনো ব্যাংক পরিচালকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। কে এর উদ্যোগ নিবে? দুদক? নাকি বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগী হবে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এখনো এসব বিষয়ে কিছুই বলা হচ্ছে না। শুধু ব্যাংকখাতের স্থিতিশীলতা আনার কাজেই ব্যস্ত সময় পার করছে। অথচ জনপ্রত্যাশা ছিল, পরিবর্তনের পরপর অন্তত আর্থিকখাতের লুটপাটে জড়িত মালিকদের একটি বড় অংশকে দ্রæতই আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।
সম্প্রতি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, এক্সিম, গেøাবল ইসলামী ব্যাংক (সাবেক এনআরবি গেøাবাল), সোশ্যাল ইসলামী, আইসিবি ইসলামিক ও ইউনিয়ন ব্যাংক, দুর্বল এই ছয়টি ব্যাংকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সাময়িক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, যাতে নিরীক্ষা কার্যক্রমে তারা প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন। যদি নিরীক্ষায় কোন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুর্নীতির প্রমাণ মেলে তাহলে আর চাকরিতে ফিরতে পারবেন না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নেয়া হবে আইনানুগ ব্যবস্থাও।
ব্যাংকখাতে যে লুটপাট হয়েছে তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় মালিক তথা পরিচালনা পর্ষদের লোকজন ছিল না। বরং ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পর্ষদই এসব অনিয়মগুলো ঘটিয়ে দেয়ার পথ বাতলে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক তারা মালিকদের আদেশ পালন করেছে। বর্তমান শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক অনুষ্ঠানে একবার বলেছিলেন, দেশ থেকে যে টাকা পাচার হয়েছে তা নিশ্চয়ই ট্রাক বা বস্তায় ভরে পাচার হয়নি। ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবহার করেই পাচার হয়েছে। শেষ কোন অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাগুলো গেছে, তার মালিকদের ধরলেই তো পাচার করা টাকার হদিছ মিলে যায়।
অর্থাৎ এটা স্পষ্ট, ব্যাংকারদের সহায়তা ছাড়া ব্যাংকখাতে লুটপাট সম্ভব ছিল না। এমন বাস্তবতায় তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা, তা সাধারণ মানুষ জানতে চায়। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির দায়িত্বে থাকা যেসব কর্মকর্তা, যারা ইচ্ছে করে দুর্বল নজরদারি করেছেন কিংবা উচ্চ পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তার আদেশে নজরদারি করতে পারেননি তাদের কী চিহ্নিত করা হবে? এখন পর্যন্ত এমন কোন খবর গণমাধ্যমে আসেনি। বরং আগের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা কিছু কর্মকর্তারা ৫ আগস্টের পর বৈষম্য বিরোধী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন।
এর বাইরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে মালিকরা ইচ্ছেমতো নিয়মবর্হিভ‚তভাবে যেসব অদক্ষ কর্মী নিয়োগ দিয়েছিল, তাদের বিষয়ে কী কোনো সিদ্ধান্ত হবে? এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি হওয়ার আগে সরকারি ব্যাংকে যেসব নিয়োগ হয়েছিল সেগুলো কী রিভিউ করা হবে? এসব প্রশ্নের জবাব আমাদের এখানো জানা নেই। লুটপাটের টাকা উদ্ধার করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি ব্যাংকখাতে সুশাসন বাড়াতে হলে এসব প্রশ্নের সুরাহাও জরুরী।
এদিকে টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করার উদ্যোগ কী সঠিক ছিল? দুর্বল ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণ লুটপাটের গর্ত তৈরি হয়েছে তা কী এই টাকায় ভরাট করা সম্ভব? না হলে কেন সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা দেয়া হলো? তাও আবার ছাপিয়ে। দিয়েই যেহেতু ফেলা হয়েছে, তাহলে এসব ব্যাংকের খরচ কমানোর কোন উদ্যোগ কী নেয়া হবে, যাতে তারা কিছু নিজের বাঁচিয়ে হলেও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারে?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী