ট্রাম্পে কী প্রাপ্তি ঢাকা-দিল্লির ?
ক্ষমতা বদলালেও মার্কিন নীতি বদলে না বলে একটা মুখস্থ কথা আছে। দিনে দিনে সেই কথাটি আর টিকছে না। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তা আরো তুঙ্গে তুলে দিলেন। হোয়াইট হাউসে অভিষেক করেই খড়গ চালালেন বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিতে। হোমওয়ার্ক আগেই করে রেখেছিলেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই বাতিল করে দিলেন বাইডেন জমানার ৭৮টি নির্বাহী আদেশ। সরে গেছেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে। চালালেন অবৈধ অভিবাসীদের ধরপাকড়ের স্টিম রোলারও। এটি যারা কেবল সন্তান জন্ম দেয়ানোর জন্যে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশে যান, তাদের জন্য খারাপ খবর। ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরে অবৈধ দখলদার ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে দেয়া নিষেধাজ্ঞা তো বাতিল করেছেনই। এমনকি ক্যাপিটল হিল দাঙ্গায় গ্রেপ্তার ১৫০০ জন সমর্থককে কারামুক্তিতে সই দিতেও দেরি করেননি। নির্বাহী আদেশে ৯০ দিনের জন্য বিশ্বের সব দেশে মার্কিন সহায়তা স্থগিত করে দিলেন চোখের পলকে।
নীতি বদলের টাটকা উদাহরণ আর কী হতে পারে? জুনিয়র বুশ আর তার পর বারাক ওবামার পলিসি ছিল সন্ত্রাসবাদ ঠেকানো, তারা নিজেদের ফার্মে তৈরি লাদেনকে নিজেরাই খতম করে দিয়েছেন। ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যেকে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে তালেবানদের সাথে দোহা চুক্তি করে আফগানিস্তান থেকে বুশের নিয়োগ করা সেনা প্রত্যাহার করেছেন। আফগানিস্তানকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তালেবানদের হাতে। বাইডেনের ফোকাস ছিলো গনতন্ত্র মানবাধিকার। তারা পৃথিবীর নানা দেশে রেজিম পরিবর্তন করিয়েছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করালো বাইডেন। বন্ধ করতে চাইছেন ট্রাম্প। কমলা হ্যারিস এলেও কি আগের নীতিতে অটল থাকতেন? ভোটের আগে কমলা হ্যারিস ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিজ দলের নীতি পরিবর্তনের কথা জানিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থে নীতি বানায়। দরকার হলে বদলায়। দেশে দেশে আইনের শাসন কায়েমে অনেক খরচপাতি করে। আবার দায়িত্ব ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে নির্বাহী ক্ষমতায় নজিরবিহীনভাবে ভাই,ছেলে,ভায়রা ভাই,শালীর দন্ড মাফ করে দেয়। বিশ্বের অনেক দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বদলের সাথে পৌষ মাস আসে। কোনো কোনো দেশে মরা কার্তিকও নামে। মার্কিন মল্লুকের নীতির হেরফেরে বাংলাদেশের কি কিছু আসে-যায়? ভারতেই বা কী? ভারত আর বাংলাদেশ, বিশ্বের সবারই কম-বেশি আসে যায় মার্কিন কারনে। নইলে কি ভারতের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কারোপের হুমকি, তার শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ না জানানো নিয়ে এখনো এতো আলোচনা। সঙ্গে সমালোচনাসহ নানা প্রশ্নও। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সুসম্পর্কের কথা বলা হলেও বাস্তবতা কী? ট্রাম্প ভারতের বন্ধু না শত্রু? এসব প্রশ্নে কূটনৈতিক পন্থায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আমেরিকান জাতীয়তাবাদী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আবার এও বলেছেন, সেখানে তাকে অনেক সমাদর করা হয়েছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্ট অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে ক্ষমতায় না গিয়েও বিএনপি সম্মানিত হয়েছে। এর সমান্তরাল ঘটনা, নরেন্দ্র মোদী বছর শুরুর সাতাশ দিন পর ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছে lএর আগে, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার এক সপ্তাহ না যেতেই যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ও বৃহৎ বাণিজ্য চুক্তি করলো বাংলাদেশের সাথে। ট্রাম্পের অভিষেকের পর তার নতুন এনার্জি এক্সপোর্ট ম্যান্ডেট উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের এই ল্যান্ডমার্ক এগ্রিমেন্ট সাইনে ভারতের মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিকlট্রাম্পের ইলেকশন প্রমিজের মধ্যে ‘ড্রিল, বেবী ড্রিল’ এই স্লোগানটা বেশ পপুলার ছিলো। সেটা এই এনার্জি এক্সপোর্ট কে ঘিরেই। আরেক জায়গায় এই সাইনিংয়ের গুরুত্ব রয়েছে। সেটি ইকনমিক ডিপ্লোম্যাসি, মানে অর্থনৈতিক কূটনীতি। ওই চুক্তির এক সপ্তাহ না যেতেই ট্রাম্পের বিজনেস পার্টনার জেন্ট্রি বিচ ঢাকা সফর করে গেছেন। আরেক ধনকুবের ইলোন মাস্ক বাংলাদেশে আসার পাইপলাইনে আছেন।
দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাহী আদেশে ৯০ দিনের জন্য বিশ্বের সব দেশে মার্কিন সহায়তা স্থগিত করলেও ইউএসএইডের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ইউএসএইডের পুষ্টি সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত থাকার বিষয়টি সেখানে উঠে আসে সেখানে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয়দের জন্য পুষ্টি সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা—ইউএসএইড। খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা প্রদানে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে থাকে এই সংস্থটি। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৪০ কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার, যার মধ্যে বাংলাদেশই পেয়েছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক সহায়তা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশকে প্রতিবছর দেয়া সহায়তার পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। এর আগের বছরগুলোতে আড়াইশো থেকে তিনশো মিলিয়ন ডলারের মার্কিন সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২৪ সালে এই সংখ্যাটা প্রায় ৪৯০ মিলিয়ন ডলার। ইউএসএইডের তথ্য বলছে, এই অর্থ যেসব খাতে ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা, পরিবেশ ও জ্বালানি এবং মানবিক সহায়তা। এছাড়া, রোহিঙ্গাদের জরুরি সহায়তার জন্যও বরাদ্দ ছিল এতে।
জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকের মত বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমেও বিভিন্ন দেশে সহায়তা দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। তবে, দেশটির সহায়তার উল্লেখযোগ্য অংশ আসে ইউএসএইডের মাধ্যমে। বাংলাদেশে এই সংস্থাটির কার্যক্রমের মূল ক্ষেত্রগুলো হলো- খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি, গণতন্ত্র মানবাধিকার ও শাসন, পরিবেশ ও জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, রোহিঙ্গা শরণার্থী সহায়তা। এরপরও অপেক্ষার বিষয় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আপনজন বলে প্রচারিত ডক্টর ইউনুস তার সম্পর্ক দিয়ে সহায়তা আরো কতো বাড়াতে পারেন, সেই অপেক্ষা অনেকেরই। সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর প্রধান উপদেষ্টার থ্রি জিরো নিয়ে প্রসংশা করায় আশায় কিছু মাত্রা যোগ হয়েছে। মাত্রাগতভাবে এর ভিন্নতাও আছে। ট্রাম্প সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েই মার্কো রুবিও সবার আগে যে তিনটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন তার একজন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, তারা বাংলাদেশ নিয়ে কিছু আলাপ আলোচনা করেছেন। কিন্তু, কী আলোচনা করেছেন তা জানাননি।
‘যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া পড়শীর ঘুম নাই’-এর মতো বাংলাদেশকে নিয়ে পড়শীদের কিছু বাড়াবাড়ি আছে। আবার আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক পরিসরেও বাংলাদেশ নিয়ে কিছু আলোচনা আছে। থাকারই কথা। এটাই বাস্তবতা। ভবিষ্যতে কেবল ভারত নয়, বাংলাদেশ নিয়ে পাকিস্তান, তুরস্ক, চীন, রাশিয়া, এমন কি যুক্তরাষ্ট্রকেও আরো বেশি ভাবতে হবে। ভাবনার ওই জায়গায় বাংলাদেশ প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মোকাম হয়ে গেছে আরো ঢের আগেই।
মোস্তফা কামাল
সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন